সম্রাট শেরশাহ ছিলেন এই পুজো শুরুর নেপথ্যে , স্বপ্নাদেশ পেয়ে এবাড়িতেই শুরু হয়ে ছিল মা দুর্গার আরাধনাও
বেস্ট কলকাতা নিউজ : কোনও ক্লাব বা বারোয়ারি দুর্গা পুজো নয়। এই দুর্গা পুজো একেবারে খোদ বনেদি ব্রাহ্মণ পরিবারের পুজো। তবুও এ বাড়ির দুর্গা পুজোয় প্রতি মুহুর্তে উচ্চারিত হয় সম্রাট শেরশাহের নাম। হ্যাঁ, এটাই যেন পূর্ব বর্ধমানের জামালপুরের কোলসরা গ্রামের ঘোষাল বাড়ির দুর্গা পুজোর এক মাহাত্ম্য। সেই মাহাত্ম্যকে আাঁকড়েই এই বাড়িতে ৩৭০ বছর ধরে হয়ে আসছে দেবী দুর্গার আরাধনা। দশমীর দিন ১১ কুমারীর পুজো ঘোষাল বাড়ির দুর্গোৎসবকে পৌঁছে দেয় আর এক ভিন্ন মাধুর্য্যে।
ভূকৈলাশের রাজবংশের বংশধর বলে এলাকায় পরিচিত কোলসরার ঘোষাল পরিবারের সদস্যরা। রাজবংশের সেই জৌলুস এখন আর নেই। তবে দুর্গা পুজোয় পরিবারের সাবেকি পরম্পরা ও রীতি রেওয়াজ আজও সমান্তরাল ভাবেই বহমান রয়েছে। ঘোষাল পরিবারের বর্তমান বংশধর সমীর ঘোষাল বলেন, “আমাদের বংশের ১১তম পূর্বপুরুষ সম্রাট শেরশাহের অধীনে কাজ করতেন। রাজবংশের রীতি রেওয়াজ ও আদবকায়দা সেই সময়কাল থেকেই মেনে আসা হচ্ছে।” সমীর ঘোষাল আরও জানান, তাঁদের বংশের সপ্তম পুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র ঘোষালই প্রথম মূর্তি গড়ে দুর্গা পুজোর সূচনা করেছিলেন।
কথিত আছে, বহুকাল আগে কোলসরা গ্রামের এক প্রান্ত দিয়ে বয়ে যেত কংসা নদী। নদী তীরবর্তী অংশে ছিল বিশাল কলাবাগান। সেই সময়ে ঈশ্বরচন্দ্র ঘোষাল কংসা নদী দিয়ে যাতায়াতের পথে কলাবাগানে একটি বাচ্চা মেয়েকে দেখতে পান। ঈশ্বরচন্দ্র কছাকাছি যেতেই বাচ্চা মেয়েটি হঠাৎই অদৃশ্য হয়ে যায়। এরপরই দেবী দুর্গার স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র ঘোষাল। সেই স্বপ্নাদেশ মেনে ১৬৫৫ খ্রীষ্টাব্দ থেকে তিনি ঘোষাল বাড়িতে দুর্গা পুজোর সূচনা করেন। সেই পুজোর ঐতিহ্য আজও বহন করে চলেছেন বর্তমান বংশধররা।
পূর্ব পুরুষের তৈরি ঠাকুর দালানেই প্রতি বছর হয় পুজো। জন্মাষ্টমী তিথিতে একচালার কাঠামোয় দেবী মূর্তি গড়ার কাজ শুরু হয়। প্রতিমা সাজানো হয় ডাকের সাজে। প্রতিপদের দিন থেকে শুরু হয় পুজো। ৯ দিন ধরে বংশের মন্দিরে হয় পুজো পাঠ। অষ্টমীতে গরিব মানুষজনের মধ্যে নতুন জামা-কাপড় বিলি করা হয়। দশমীতে ১১ কুমারির পুজোর রীতি আজও চালু আছে ঘোষাল বাড়িতে। প্রতিপদ থেকেই দেবীর সামনে ভোগ অন্ন নিবেদন করা হয়। ভোগ রান্না করা থেকে শুরু করে দধিকর্মা তৈরি ঘোষাল বাড়ির পুজোয় সবই হয় গঙ্গা জলে। সূচনা কালের রীতি মেনে প্রতিদিনের পুজোর নৈবেদ্যতে থোড়, মোচা ও কলা দেওয়া হয়। আগে ছাগল বলি হত। তবে এখন ঘোষাল বাড়ির পুজোয় বলি দান আর হয় না।
কোলসরার ঘোষাল বাড়ির পুজোর সঙ্গে নানা কাহিনীও জড়িয়ে আছে। পরিবারের প্রবীণদের কথায়, ভূকৈলাসের রাজ পরিবারের বংশধর দিগম্বর ঘোষাল ছিলেন সম্রাট শেরশাহের বিশ্বস্ত কর্মচারী। সম্রাট জিটি রোড তৈরির কাজ দেখার দায়িত্ব দিয়েছিলেন দিগম্বর ঘোষালকে। সেই সূত্রেই জলপথে ঘুরতে-ঘুরতে একদিন দিগম্বর ঘোষাল কংসা নদীতে নোঙর ভাসিয়ে চলে আসেন জামালপুরের কোলসরা গ্রামে। সেখানেই তিনি রাতে ছিলেন। ওই রাতেই দেবী সিদ্ধেশ্বরী কালী স্বপ্নাদেশে কোলসরা গ্রামে তাঁকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য নির্দেশ দেন দিগম্বর ঘোষালকে।
দেবীর সেই নির্দেশের কথা শেরশাহকে জানান দিগম্বর। সব শুনে শেরশাহ আন্তরিকভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। দেবীর মন্দির তৈরি-সহ সারা বছর পুজোর যাবতীয় আয়োজন সম্পূর্ণ করার জন্য ১৫৪০ খ্রীষ্টাব্দে ৫০০ বিঘা জমি দিগম্বরকে দান করেন শেরশাহ। দান পত্র স্বত্ত্ব শেরশাহ একটি তাম্রপাত্রে খোদাই করে দিয়েছিলেন। শেরশাহর দান করা সেই জমিতেই ঈশ্বরচন্দ্র ঘোষাল মন্দির গড়ে দেবীর পুজোর সূচনা করেছিলেন। স্বপ্নাদেশ দেওয়া দেবীর পুজো অর্চনার জন্য এমন মহানুভবতা দেখানোর সুবাদেই সম্রাট শেরশাহ আজও ঘোষাল পরিবারের সদস্যদের হৃদয়ে রয়েছেন।