আজও অনেকেরই অজানা বাংলার গঙ্গা তীরের প্রাচীন এই শহরের জমজমাট রাস উৎসবের ইতিহাস
বেস্ট কলকাতা নিউজ : নবদ্বীপ, শান্তিপুর, কৃষ্ণনগরের রাস উৎসব রাজ্যের মানুষের মুখে মুখে। কিন্তু বাংলার অন্যতম পুরানো শহর দাঁইহাটের প্রায় আড়াইশো বছরের রাস উৎসব এখনও অনেকটাই প্রচার বিমুখ। আঞ্চলিক ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি গবেষক ড. স্বপনকুমার ঠাকুরের আপসোস, ‘এত প্রচীন একটা সংস্কৃতি এখনও অনেকের অজানা।’ এ ব্যাপারে সরকারি উদ্যোগের প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। এদিকে সোমবার দাঁইহাটে রাসপুজো। মঙ্গলবার শোভাযাত্রা। উৎসবে মাতোয়ারা পূর্ব বর্ধমানের ভাগীরথী তীরের এই প্রাচীন জনপদ।
এখানে রাসপূর্ণিমাতে কালীপুজোর আয়োজন করে বেশ কয়েকটি ক্লাব। জগন্নাথতলার ৮ হাত বিশিষ্ট কালীর রুদ্রমূর্তি বেশ আকর্ষণীয়। এবার দাঁইহাটে মোট পুজোর সংখ্যা ৬৬টি। আগামিকাল ৪২ টা ক্লাব শোভাযাত্রায় অংশ নেবে। রাস উৎসবেও নানা থিম নিয়ে হাজির হয়েছে ক্লাবগুলি। বিবেকানন্দ ক্লাব রাজস্থানের শিষমহল, দাঁইহাট সাহাপাড়া নাগরিক মঞ্চ কাশ্মীরের গুলমার্গ করে আকর্ষণ সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। রেড সান ক্লাব বর্ধমানের রাজবাড়ি বানিয়ে ফেলেছে। এখানে শোভাযাত্রার মূল আকর্ষণ চন্দন নগরের আলোকসজ্জা।
ইতিহাসবিদ ড. স্বপনকুমার ঠাকুর বলেন, ‘নবদ্বীপের রাসের প্রবর্তক যদি রাজা কৃষ্ণচন্দ্র হন তাহলে দাঁইহাটের রাসেরও অনুপ্রেরণা তিনিই। নবদ্বীপের একটা এডিশন দাঁইহাট। কিছু সংখ্যক মানুষ দাঁইহাটের রাস উৎসবের বিষয়টি জানেন, তাঁরা এই লেখা সংক্রান্ত বই পড়েন। কিন্তু সাধারণ মানুষের বড় অংশই এখানকার রাস সম্পর্কে জানে না। সরকারেরও এব্যাপারে উদাসীনতা রয়েছে। স্বভাবত আপসোস তো থাকবেই।’
দাঁইহাটের উৎসব নবদ্বীপের রাসের সমসাময়িক বলেই দাবি করেছেন এই লোকসংস্কৃতি গবেষক। তাঁর মতে, ‘গঙ্গার এই তীরবর্তী জনপদ দ্বাদশ তীর্থে পরিণত হয়েছিল। মধ্যযুগের সমৃদ্ধ শহর ছিল ইন্দ্রাণী। সেই নাম পরে দ্রাইন, তারপর দাঁইহাট। ইন্দ্রানী নগর প্রথমে ইসলামি আমলে একরকম ধংস হল পরে বর্গী হামলায়। এখানকার মানুষজন তখন বেশিরভাগ চলে গেল পূর্ববঙ্গের দিকে। বাকি লোক চলে গেল কলকাতার দিকে। ইন্দ্রাণী অঞ্চলে অষ্টম-নবম শতাব্দীর শৈব মন্দির পাওয়া গিয়েছে। জৈন কভার প্লেট পাওয়া গিয়েছে। এই সভ্যতা ধংস হওয়ার পর নবদ্বীপের অনুকরণে রাস এসে গেল। ১৭৮০ বা অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে এখানে রাস উৎসবের সূচনা হয়। এখানে প্রথম দিকে পটের রাসও হত। পট আঁকতো কুম্ভকার সম্প্রদায়। নবদ্বীপের রাসের সঙ্গে এখানকার রাসের মিল খুঁজে পান তিনি। তাঁর মতে, নবদ্বীপে উগ্রচন্ডা আছে এখানেও আছে। কালী আছে। ওখানেও আছে। বৈষ্ণব প্রভাব নবদ্বীপ বা দাঁইহাটে খুব বেশি নেই। থাকা মূর্তি আছে।’
এই প্রাচীণ রাস উৎসবের তেমন প্রচার নেই। অনেকে জানেন না। এমনটাই মত পূর্ব বর্ধমানের এই গবেষকের। তিনি বলেন, ‘১৮৬৯ সালের ১ এপ্রিল দাঁইহাট ও কাটোয়া পুরসভা স্থাপিত হয়। ১৮৫৫ সালের ২৯ অক্টোবর এখানে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষা প্রসারে উদ্যোগী হয়েছিলেন স্বয়ং বিদ্যাসাগর। তাঁর উদ্যেগে বাংলায় যে ২০ টি স্কুল প্রতিষ্ঠা হয়েছিল দাঁইহাট তার মধ্যে অন্যতম। কবি কাশিরাম দাস এই অঞ্চলের কবি। তাঁর লেখায় ইন্দ্রানীর উল্লেখ আছে। আছে দ্বাদশ তীর্থের কথা।’ এমন প্রচীন শহরের রাস উৎসবের প্রচারে সরকারের আরও উদ্যোগ নেওয়া উচিত বলে মনে করে দাঁইহাটবাসীও।