অশান্তির বীজ বুনছে ‘বিজেপি’ কেন্দ্রকে তীব্র নিশানা কংগ্রেসের, মণিপুরে আদিবাসী সম্প্রদায়ের তোপের মুখে মুখ্যমন্ত্রী
বেস্ট কলকাতা নিউজ : ক্রমশ হিংসার আগুনে জ্বলছে মণিপুর। দেখা মাত্র গুলির নির্দেশ। রাজ্যের আটটি জেলায় কারফিউ জারি করা হয়েছে। রাজ্য জুড়ে মোবাইল ইন্টারনেট পরিষেবা স্থগিত করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর একজন মুখপাত্র বলেছেন, বুধবার নাগা ও কুকি উপজাতিদের দ্বারা উপজাতি সংহতি মিছিলের পর সহিংসতা শুরু হয়, যা রাতে আরও তীব্র হয়। সমস্ত জেলাশাসক, সাব ডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট, এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট, স্পেশাল এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটকে এই নোটিশ ইস্যু করার জন্য অনুমোদন করা হয়েছে। রাজ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনতেই এই পদক্ষেপ বলেই জানিয়েছেন রাজ্যপাল। ইম্ফল উপত্যকায় মৈতেই জনজাতির তরফে দাবি তোলা হয়েছে, তাদের তফশিলি উপজাতির তকমা দিতে হবে। যদিও মৈতেইদের এই দাবি মানতে পারছেন না স্থানীয় কুকি সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা। তা থেকেই বিরোধের সূত্রপাত। তার জেরে ক্রমেই ছড়াচ্ছে হিংসা।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মণিপুরে, মোতায়েন করা হয়েছে সেনা, নিরাপদ স্থানে সরানো হল কয়েক হাজার মানুষকে। আদিবাসীদের বিক্ষোভ ঘিরে ধুন্ধুমার পরিস্থিতি পার্বত্য রাজ্যে মনিপুরে। জানা গিয়েছে, শান্তি বজায় রাখতে ফ্ল্যাগ মার্চ করছে সেনা। এর আগে গত মাসে মুখ্যমন্ত্রীর সভাস্থলে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল উত্তেজিত জনতা। আর সম্প্রতি মৈতেই গোষ্ঠীর সঙ্গে সংঘর্ষ বেঁধেছে আদিবাসী সম্প্রদায়ের। এই আবহে রাজ্যের আট জেলায় জারি হয়েছে কার্ফু। ৫ দিনের বন্ধ হয়েছে ইন্টারনেট পরিষেবা। মণিপুর হাইকোর্টের একটি রায় পার্বত্য রাজ্যে উত্তেজনা বাড়িয়েছে। পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর জওয়ানরা রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় ফ্ল্যাগ মার্চ করছেন। সেনাবাহিনী জানিয়েছে, মণিপুর প্রশাসনের আবেদনে বিভিন্ন এলাকায় সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। ৩ মে সন্ধ্যা থেকেই রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষার চেষ্টা চলছে।
বুধবার বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন অল ট্রাইবাল স্টুডেন্টস ইউনিয়নের ব্যানারে মণিপুরের ১০টি জেলায় মিছিল করেছে, যাতে বিপুল সংখ্যক মানুষ অংশ নেয়। বিক্ষোভকারীরা মৈতেই সম্প্রদায়কে উপজাতি মর্যাদা দেওয়ার বিরোধিতা করছে। গত ১৯শে এপ্রিল, মণিপুর হাইকোর্ট তার একটি সিদ্ধান্তে জানায় যে সরকারের মৈতেই সম্প্রদায়কে উপজাতি বিভাগে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত এবং হাইকোর্ট এর জন্য রাজ্য সরকারকে চার সপ্তাহ সময় দিয়েছে। রায়ের প্রতিবাদে মণিপুরের বিষ্ণুপুর ও চন্দ্রচুড়পুর জেলায় হিংসা ছড়ায়। সরকার পাঁচ দিনের জন্য রাজ্যে মোবাইল ইন্টারনেট পরিষেবা স্থগিত করেছে। চন্দ্রচুড়পুর জেলায় কারফিউ জারি করা হয়েছে।
মণিপুরে হিংসার কারণ – বুধবারের হিংসা নিয়ন্ত্রণে আনতে মণিপুরের বিভিন্ন জেলায় মোতায়েন করা হয়েছে সেনা এবং অসম রাইফেল পার্সোনাল। হিংসায় রাশ টানতে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ইন্টারনেট পরিষেবা। বিভিন্ন জেলায় জারি করা হয়েছে কারফিউ। ইম্ফল উপত্যকায় মৈতেইরা সংখ্যা গরিষ্ঠ। এঁরা হিন্দু। উপত্যকার পাঁচটি জেলায়ই এঁদের আধিপত্য রয়েছে। যদিও পাহাড়ি জেলাগুলিতে নাগা এবং কুকি উপজাতিদের আধিপত্য।এই কুকি এবং নাগারা হলেন খ্রিস্টান। পাহাড়ের চার জেলায় কুকিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। মণিপুরের মোট জনসংখ্যার ৫৩ শতাংশ মৈতেই। যদিও গোটা রাজ্যের মাত্র ১০ শতাংশ এলাকায় বাস তাদের। যদিও মৈতেইদের দাবি, এটা কোনও ইস্যুই নয়। আসল কারণটা হচ্ছে, রাজ্য সরকার যে রিজার্ভ ফরেস্ট এলাকা থেকে অনুপ্রবেশকারীদের তাড়াতে চাইছে, তাতেই ভয় পেয়েছে কুকিরা। তার জেরেই অশান্তির সূত্রপাত।
কংগ্রেস অভিযোগ করেছে যে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) তার ঘৃণার রাজনীতি দিয়ে সম্প্রদায়ের মধ্যে ফাটল তৈরি করেছে, যার কারণেই মণিপুর জ্বলছে। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী উত্তর-পূর্ব রাজ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাছে আবেদন করেছেন। কংগ্রেস বলেছে যে মণিপুরে আইন-শৃঙ্খলার পরিস্থিতি বিঘ্নিত হওয়ার কারণে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে অবিলম্বে তাঁর পদ থেকে বরখাস্ত করা উচিত এবং ভারতীয় জনতা পার্টির উচিত মণিপুরে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা।
কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে এবং কংগ্রেস রাহুল গান্ধীও মণিপুরের জনগণকে শান্তি বজায় রাখার আবেদন করেছেন। মল্লিকার্জুন খাড়গে টুইট বার্তায় লিখেছেন, ‘মণিপুর জ্বলছে। বিজেপি সম্প্রদায়ের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করেছে এবং এই সুন্দর রাজ্যের শান্তি নষ্ট করেছে। বিজেপির বিদ্বেষ ও বিভাজনের রাজনীতি এবং ক্ষমতার লোভ এই সমস্যার জন্য দায়ী। আমরা সকল পক্ষের কাছে শান্তি বজায় রাখার আবেদন করছি’
কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক জয়রাম রমেশ টুইট করেছেন, ‘বিজেপি বিধানসভা নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। নির্বাচনের ১৫ মাস পর মণিপুরে ডাবল ইঞ্জিন সরকারের দৌলতে রাজ্যে আগুন জ্বলছে। নীরব কেন্দ্রীয় সরকার। কর্ণাটকে প্রচারে ব্যস্ত প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
প্রতিবাদের কারণ : প্রতিবাদের অনেক কারণ আছে, তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল জনসংখ্যা এবং রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব উভয় ক্ষেত্রেই মৈতেই সম্প্রদায়ের আধিপত্য। রাজ্য বিধানসভার ৬০টি আসনের মধ্যে ৪০টি আসনে মৈতেই সম্প্রদায় সংখ্যাগরিষ্ঠ। এমন পরিস্থিতিতে আদিবাসীদের আশঙ্কা, মৈতেই সম্প্রদায় যদি এসটি মর্যাদা পায়, তাহলে তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যাবে। অশান্তির জেরে কুকি বিধায়কদের একটি দল মঙ্গলবার বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে দেখা করতে দিল্লি পৌঁছায়। তাদের দাবি দলের রাজ্য নেতৃত্বে পরিবর্তন, বিশেষ করে মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেনের বদল।
বিধায়কদের মধ্যে একজন, দাবি করেছেন যে রাজ্য প্রশাসন গত কয়েক বছরে মণিপুরের সম্প্রদায়কে “মেরুকরণ” করেছে, সম্প্রতি চুরাচাঁদপুর জেলার সংরক্ষিত বনভূমি থেকে গ্রামবাসীদের উচ্ছেকেই হিংসার কারণ বলে অভিহিত করেন তিনি। যদিও রাজ্য সরকার দাবি করেছে যে ইম্ফল উপত্যকায় একই রকম উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে, যেটি মৈতেই সম্প্রদায়ের অধ্যুষিত অঞ্চল। হাওকিপ সহ কুকি নেতারা উল্লেখ করেছেন যে বীরেন বারবার চুরাচাঁদপুর সম্প্রদায়কে “বিদেশী” এবং “বহিরাগত” বলে ইঙ্গিত করেছেন, যারা মায়ানমার থেকে মণিপুরে বসতি স্থাপন করেছেন।
দু’দিন আগে, মুখ্যমন্ত্রীর অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে বীরেন-এর একটি বার্তাও বিক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। হাওকিপ বলেছিলেন, “ভয় হল যে মৈতেইরা আদিবাসীদের জমি দখল করার চেষ্টা করছে, আমি মৈতেই বিরোধী নই, তবে একজন আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে আদিবাসীদের উদ্বেগ ও দাবি তুলে ধরা আমার কর্তব্য।”