অন্তরঙ্গ নাট্য উৎসব পালিত হয়ে গেল পানিহাটি ব্রাত্যজন ও খড়দহ থিয়েটার জোন এর যৌথ উদ্যোগে
নিজস্ব সংবাদাতা : খড়দহ থিয়েটার জোন এবং পানিহাটি ব্রাত্যজন-এর যৌথ উদ্যোগে অন্তরঙ্গ নাট্য উৎসব হয়ে গেল ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বর ২০২০ ‘থিয়ে এপেক্স’-এ। দু দিনের উৎসবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ঠ নাট্যজনেরা এবং অনুষ্ঠিত হয় মোট পাঁচটি নাটক। উদ্বোধক রূপে উপস্থিত থাকার কথা ছিল শ্রী ব্রাত্য বসুর। কিন্তু জরুরি মিটিং থাকার কারণে তিনি উপস্থিত থাকতে পারেননি। উপস্থিত ছিলেন শ্রী প্রবীর গুহ, শ্রী সলিল সরকার ও শ্রী অঞ্জন দেব। পরিবেশিত হয় দুটি নাটক। প্রথমটি ‘খড়দহ থিয়েটার জোন’-এর নাটক ‘ঘরে বাইরে’ ও দ্বিতীয়টি ‘একটি প্রযোজনা’-এর নাটক ‘এক চিলতে রোদ্দুর’।
অনুষ্ঠানের শুরুতে বক্তব্য রাখেন শ্রী সলিল সরকার। তার কথায় উঠে আসে কলকাতার থিয়েটার-এর শুরুর দিকের অনেক কথা। এই করোনাকালীন সময় বর্তমান থিয়েটার কিভাবে হবে এ নিয়ে যখন সবাই ভাবনা-চিন্তা করছে তখন তার এই বক্তব্য অত্যন্ত মূল্যবান। সময়ের সাথে থিয়েটার কে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি যেভাবে পাল্টেছে সেই পরিবর্তনের ইতিহাস জানাটা আমাদের সবার পক্ষেই খুব গুরুত্বপূর্ণ। তারপর বক্তব্য রাখেন শ্রী প্রবীর গুহ। তিনি তার দীর্ঘ থিয়েটার যাপন নিয়ে বক্তব্য রাখেন। তার বিশ্বাস, তার অভিজ্ঞতার কথা বলেন। বলেন কীভাবে তিনি গ্রামের বিভিন্ন লোকশিল্পের দ্বারা অনুপ্রাণিত হন এবং পরবর্তীতে তার থিয়েটারে তিনি সেগুলিকে আনার চেষ্টা করেন।
তিনি সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে যাতে থিয়েটার পৌঁছে যায় তার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। তিনি তার অদ্বৈতবাদের বিশ্বাসের কথা বলেন। তিনি নারী পুরুষ এবং সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মেলবন্ধন ঘটানোর চেষ্টা করেন তার থিয়েটারে। তার এই দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার নানা দিক উঠে আসে তার বক্তব্যে। একটা মানুষ ঠিক কতটা লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার পর এই জায়গায় পৌঁছায় সেটা তার কথার মাধ্যমেই বোঝা যায়। এনাদের কথার পর শ্রী অঞ্জন দেব একটি গান করেন। তিনি বলেন অনেক কথা বলার চেয়ে একটি গান অনেক অর্থ বহন করে। তার সেই গানে প্রতিটি দর্শক অংশগ্রহণ করেন। এইখান থেকেই হয়তো এই উৎসব অন্তরঙ্গ হয়ে ওঠে যেখানে দর্শক এবং বক্তার কোন পার্থক্য থাকে না। সকলেই এক হয়ে ওঠেন।
তারপর অনুষ্ঠিত হয় খড়দহ থিয়েটার জোন-এর নাটক ‘ঘরে বাইরে’। আমাদের সমাজে নারীদের নিয়ে অনেক অশালীন কাজ এখনোও অনবরত ঘটে চলেছে। সেই অশালীনতার বিরুদ্ধে একটি পদক্ষেপ বলা চলে এই নাটকটি। তপন দাস নির্দেশিত এই নাটকটিতে একক অভিনয় করেছেন নিবেদিতা দাস এবং আলো করেছেন সাগর দাস। বেশ কিছুদিন ধরেই এই নাটকটির অভিনয় হচ্ছে নানান স্থানে। এই প্রযোজনাটির বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট। নিবেদিতা দাস-এর দক্ষ অভিনয় এবং তপন দাস-এর নির্দেশনার নৈপুন্যতা এই নাটকের বলতে চাওয়ার কথা গুলোকে আরো জোরের সঙ্গে দর্শকের সামনে উপস্থাপন করে।
এরপর অভিনীত হয় ‘একটি প্রযোজনা’-এর নাটক ‘এক চিলতে রোদ্দুর’। এই নাটকটিরও নির্দেশনার কাজ করেছেন শ্রী তপন দাস। একটি কর্মশালার মাধ্যমে এই প্রযোজনাটি গড়ে উঠেছে বলে তিনি জানান। নাটকটিতে আলো এবং আবহের ব্যবহার অত্যন্ত প্রশংসনীয়। এই দুইয়ের সংমিশ্রণে এক মায়াময় সময়ের সৃষ্টি হয় যা প্রতিটি দর্শককে এক অন্য জগতে প্রবেশ করায়। নাটকটিতে বেশকিছু কোরিওগ্রাফির ব্যবহার হয়েছে যা এই নাটকের প্রান স্বরুপ। প্রথম দিনের উৎসবের পরিসমাপ্তি হয় এখানেই। দ্বিতীয় দিন এই উৎসবে বক্তব্য রাখেন শ্রী ভার্গনাথ ভট্টাচার্য ও শ্রী সুপ্রিয় সমাজদার এবং অনুষ্ঠিত হয় ‘মুখ ও রা’ নাট্য দলের নাটক ‘কিছু সংলাপ’ ও খড়দহ থিয়েটার জোন-এর ‘আমি তো সেই মেয়ে’। নাটকের গান উপস্থাপিত করেন গোবরডাঙ্গা নাবিক নাট্যম। শুরুতে নাটকের গানের মধ্যে দিয়ে উৎসবের আমেজ তৈরি হয়। তারপর বক্তব্য রাখেন শ্রী ভার্গনাথ ভট্টাচার্য। তিনি একজন সংগঠক হিসেবে কিভাবে দেখছেন তার থিয়েটার যাপনকে তা নিয়ে বিস্তারিত বক্তব্য রাখেন। তারপর বক্তব্য রাখেন শ্রী সুপ্রিয় সমাজদার।
প্রায় ২৫ বছর ধরে তার অন্তরঙ্গ থিয়েটার এর সাথে পথ চলা। এক ধারার বাইরে বেরিয়ে নতুন আঙ্গিক, নতুন ধারার সূচনা করা, মুক্ত নাট্যের কথা বলার মধ্যে দিয়ে তিনি তার থাকার কথা বলেন। তিনি বেশ কিছু প্রশ্ন দর্শকদের সামনে রাখেন। থিয়েটার কেন করব? কি খুঁজতে চাইছি? কি বলতে চাইছি? কেন বলতে চাইছি? এই সব প্রশ্নের মধ্যে দিয়ে নিজেকে নিয়ে যেতে হবে। তার বক্তব্যের পর প্রর্দশিত হয় ‘মুখ ও রা’ নাট্য দলের নাটক ‘কিছু সংলাপ’। তিনি লকডাউনের সময় একজন থিয়েটার পারফর্মার ঠিক কিভাবে তার যাপনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন তার একটা অংশ তুলে ধরলেন। লোকনাথ দে তার অভিনয় দক্ষতা দিয়ে নাটকটিতে প্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। তারপর অনুষ্ঠিত হয় ‘খড়দহ থিয়েটার জোন’-এর নাটক ‘আমি তো সেই মেয়ে’। সমাজের নানান কুসংস্কার এবং নারীদের অবস্থান, তার মাঝে আছে সময়ের ব্যবধান। এই সময়ের ব্যবধান কে সঠিক রূপে বিচার করলে দেখা যাবে কিছু বছর আগেই ভারতের নানান স্থানে কিভাবে নারীদের উপর নির্যাতন চালানো হত নানান কুসংস্কারকে সংস্কারের রূপ দিয়ে।
সেরকমই কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে রচিত ‘আমি তো সেই মেয়ে’ নাটক। প্রবীর গুহ এই নাটকটির রচয়িতা। কিভাবে একের পর এক বিচ্ছিন্ন ঘটনা অবশেষে মিলেমিশে এক হয়ে যায়। প্রত্যেকটি ঘটনার সূচনা আলাদা আলাদা হলেও পরিণতিটা কতকটা একই রকম। যতই সুস্থ-স্বাভাবিক সূচনা হোক না কেন প্রত্যেকটি নারীর মৃত্যু অবশেষে অপঘাতে হতে থাকে। এখান থেকে বোঝা যায় একসময় সমাজে নারীদের অবস্থান ঠিক কেমন ছিল। তারই একটা রূপ দেখা দেয় এই নাটকে। প্রযোজনাটির ভাবনা থেকে শুরু করে কোরিওগ্রাফি সবই মনোমুগ্ধকর। দুইদিন ব্যাপী এই নাট্য উৎসবে বহু মানুষের সমাগম ঘটে। এই সবের মধ্যে দিয়ে শেষ হলো উক্ত নাট্যোৎসবের যা এই করোনা কালীন সময়ে দাঁড়িয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ। অনেক শুভেচ্ছা রইল খড়দহ থিয়েটার জোন ও পানিহাটি ব্রাত্যজনকে এমন একটি পদক্ষেপ-এর জন্য।