৭ প্রতিবেশী দেশ রয়েছে ভারতের সীমানা সংলগ্ন , চীন পাকিস্তানের সাথে কোথায় আসল সমস্যা? জেনে নিন
বেস্ট কলকাতা নিউজ : ভারতের সীমান্তে সব সময় এতটা উত্তেজনা কেন? চীন আর পাকিস্তান উঠে পড়ে লেগেছে শত্রুতার জন্য, শত্রুতার উৎসটাই বা কি? ভারতের সীমান্ত রয়েছে সাতটি দেশের সঙ্গে। কিছু দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক, আবার কিছু দেশের সঙ্গে চরম শত্রুতা। যুদ্ধ থেকে শুরু করে ঠান্ডা মাথায় আলোচনা, কোন কিছুতেই সেই শত্রুতা দূর করা যায়নি। সীমান্তের দিক থেকে ভারতের অবস্থানটা ঠিক কোথায়? আপনি কতটা নিরাপদ? একজন ভারতবাসী হিসেবে এগুলো আপনার জানা দরকার।
অক্ষাংশ অনুসারে ভারত রয়েছে উত্তর গোলার্ধে, আর দ্রাঘিমা অনুযায়ী ভারত রয়েছে পূর্ব গোলার্ধে। আয়তনের দিক থেকে ভারত সপ্তম বৃহত্তম দেশ। আমাদের দেশের আয়তন ৩২,৮৭,২৬৩ বর্গ কিলোমিটার। বলা হয় পাকিস্তান ভারতের প্রায় ৭৮ হাজার ১৪৪ বর্গ কিলোমিটার বেআইনিভাবে দখল করেছে। এছাড়াও পাকিস্তান অনৈতিকভাবে চীনকে হস্তান্তর করেছে ৫ হাজার ১৮০ বর্গকিমি জমি। চীনও কোনো অংশে কম নয়, বেআইনিভাবে ভারতের প্রায় ৩৭ হাজার ৫৫৫ বর্গ কিমি দখল করে আছে। পৃথিবীর মোট স্থলভাগের ২.৪ শতাংশ দখল করে রয়েছে ভারত। ভারত আয়তনে বাংলাদেশের থেকে ২২ গুণ, ফ্রান্সের থেকে তিনগুণ, পাকিস্তানের থেকে চার গুণ আর যুক্ত রাজ্যের থেকে প্রায় ২০ গুন বড়। অপরদিকে রাশিয়ার থেকে সাড়ে পাঁচ গুণ ছোট।
ভারতের সীমানায় রয়েছে সাতটি প্রতিবেশী দেশ। চীনের সঙ্গে ভারতের সীমান্তদৈর্ঘ্য প্রায় ৩৯১৭ কিলোমিটার। চীন আর ভারতের সীমানা স্পর্শ করে রয়েছে লাদাখ, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, সিকিম এবং অরুণাচল প্রদেশ । সীমান্ত দৈর্ঘ্যের দিক থেকে ভারতের সঙ্গে সর্বাধিক সীমান্ত ভাগ করছে বাংলাদেশ। ভারত এবং বাংলাদেশের মাঝে থাকা সীমান্ত দৈর্ঘ্য প্রায় ৪,০৯৬ কিলোমিটার। বাংলাদেশের সীমান্ত লাগোয়া ভারতের রাজ্যগুলি পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়, ত্রিপুরা, মিজোরাম এবং আসাম। ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে সীমান্ত রয়েছে প্রায় ৩৩১০ কিলোমিটার। সীমান্তের কাছে ভারতের রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল রাজস্থান, জম্মু ও কাশ্মীর, পাঞ্জাব, লাদাখ আর গুজরাট। নেপালের সঙ্গে ভারত সীমান্ত ভাগ করছে প্রায় ১,৭৫২ কিলোমিটার। সীমান্ত লাগোয়া ভারতের রাজ্যগুলি হল পশ্চিমবঙ্গ, উত্তর প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, বিহার এবং সিকিম। সীমান্ত দৈর্ঘ্যের দিক থেকে এর পরেই রয়েছে মায়ানমার। মায়ানমারের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত দৈর্ঘ্য প্রায় ১,৪৫৮ কিলোমিটার। এই সীমান্ত লাগোয়া ভারতের রাজ্যগুলি হল মণিপুর, নাগাল্যান্ড, অরুণাচল প্রদেশ এবং মিজোরাম। ভুটানের সীমান্তের সঙ্গে ভারতের যে রাজ্যগুলির সীমান্ত স্পর্শ করেছে সেই তালিকায় রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ, অসম, অরুণাচল প্রদেশ এবং সিকিম। ভুটান এবং ভারতের সীমান্ত দৈর্ঘ্য ৫৮৭ কিলোমিটার। সীমান্ত দৈর্ঘ্যের দিক থেকে প্রতিবেশী দেশ আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতের সীমান্তের পরিমাণ অনেকটাই কম। প্রায় ৮০ কিলোমিটার। আফগানিস্তানের সীমান্তের কাছে রয়েছে লাদাখ।
ভারতের সঙ্গে এই প্রতিবেশী দেশগুলির সম্পর্ক নিয়ে যেমন টানাপোড়েন রয়েছে, তেমনি আবার বন্ধুত্বের সম্পর্ক রয়েছে। এর মাঝেই রয়েছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা একজন ভারতবাসী হিসেবে মনে রাখা দরকার। ১৯৩৭ সাল নাগাদ ভারতের একটি রাজ্য হিসেবে পরিগণিত হত মায়ানমার। সেই বছরই মায়ানমার আলাদা হয়ে যায়। ১৯৪৮ সালে দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে। ভারতের প্রতিবেশী দেশ মালদ্বীপ অথচ এটি সার্কগোষ্ঠী ভুক্ত এমন একটি দেশ যার সঙ্গে ভারতের স্থল ও অথবা জলভাগের কোন সাধারণ সীমানা নেই। মালদ্বীপ রয়েছে ভারত মহাসাগরে। ২০২১ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে প্রথম ফেনী নদীর উপর মৈত্রী সেতু (১.৯ কিমি) চালু হয়। যা বাংলাদেশের রামগড়ের সঙ্গে যুক্ত করেছে ত্রিপুরার সাবরুমকে।
মূলত তিনটি প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত সমস্যার লেগেই রয়েছে। সেই তালিকায় একেবারে প্রথমে রয়েছে চীন। তারপর পাকিস্তান, শেষে বাংলাদেশ। যদি ভারত আর চীনের সীমান্ত সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হয় তাহলে বিষয়টি তিন ভাগে ভাগ করে নিতে হবে, পশ্চিম ভাগ, মধ্যভাগ এবং পূর্বভাগ। পশ্চিম ভাগে ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল অধিকার করে বসে রয়েছে চীন। এখানে জম্মু-কাশ্মীরের সঙ্গে চীনের জিনজিয়াং অঞ্চলের মধ্যে নানান সমস্যা লেগেই থাকে। মধ্যভাগের সমস্যা আরও ভয়ানক। চীন সবসময় উত্তরাখণ্ডের চিমোলি আর সিকিমের চুম্বি উপত্যকা সহ টো পয়েন্টকে নিজের বলে দাবি করে। মধ্যভাগ রয়েছে চীনের তিব্বত অঞ্চল আর ভারতের উত্তরাখণ্ড এবং হিমাচল প্রদেশে। ভুটানের পূর্বভাগ থেকে শুরু করে ভারত, মায়ানমার আর বাংলাদেশ, এই ত্রি সংযোগে রয়েছে পূর্বভাগ। যেখানে চীন অনৈতিকভাবে সবসময় ভারতের প্রায় ৯০ হাজার বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল নিজের বলের দাবি করে।
ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত সমস্যা হয়তো বলে শেষ করা যাবে না। মাঝেমধ্যে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনাময় পরিস্থিতি লেগেই রয়েছে। একে অপরের যেন চরম শত্রু। সেই ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকেই ভারত পাকিস্তানের মধ্যে সীমান্ত সমস্যার শেষ নেই। কচ্ছে রণ অঞ্চলটি নিয়ে ১৯৬৯ সালে ভারত পাকিস্তানের মধ্যে একটা সীমানা ঠিক করে দেওয়া হয়। তার আগে এই জায়গাটা নিয়ে বেশ সমস্যা ছিল। কাশ্মীরকে নিয়ে ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে সমস্যা অব্যাহত, যার কারণে ১৯৪৮, ১৯৬৫, ১৯৭১ এবং ১৯৯৯ সালে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। ভারতের গুজরাট আর পাকিস্তানের সিন্ধু অঞ্চলের মধ্যবর্তী একটি খাঁড়ি ‘স্যার ক্রিক’। এই খাঁড়ির উপর দিয়ে ভারত পাকিস্তানের একটা সীমানা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। এই অঞ্চল সামুদ্রিক সম্পদে পরিপূর্ণ। দুই দেশই খাঁড়িটিকে নিজের সীমান্তে নিয়ে আসতে চাইলে শুরু হয় বিতর্ক। সিয়াচেনে অতন্ত্র প্রহরীর মত পাহারা দিচ্ছে ভারত চীন আর পাকিস্তানের সৈন্য। এই হিমবাহের দক্ষিণ পূর্ব অংশ ভারতের ভাগে রয়েছে। এক সময় পাকিস্তান সরকার ভারতের এই অংশ জাপানি পর্যটকদের প্রবেশের অনুমতি দেয় পাশাপাশি ওই অঞ্চল নিজেদের নজরদারি অন্তর্গত করলে শুরু হয় বিবাদ।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছিল ১৯৭১ সালে, তারপরে প্রায় চারটি অঞ্চল নিয়ে ভারত বাংলাদেশের সীমান্ত সমস্যা দেখা দেয়। যা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বিরোধ বাঁধে। যদিও বর্তমানে ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে যথেষ্ট বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর যে চারটি অঞ্চল নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল সেই তালিকা রয়েছে করিমপুর ও দৌলতপুর, রাজশাহী ও মুর্শিদাবাদ, বরিশারী ও গোবিন্দপুর এর মধ্যবর্তী সীমানা এবং গারো খাসি জয়ন্তিয়া পাহাড় আর সিলেট। এছাড়াও ২০০১ সালে নতুন সমস্যার উৎপত্তি হয়। ভারতের মেঘালয়ে পিরদিভা নামক এক গ্রাম রয়েছে। বাংলাদেশ ২০০১ সালের গ্রামটি দখল করলে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা মূলক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। যদিও বর্তমানে সমস্ত সমস্যার নিষ্পত্তি ঘটেছে, দুই দেশের মধ্যে সীমান্তে বিরোধ নেই বললেই হয়।
সীমান্ত পাহারা : সাতটি দেশের সঙ্গে ভারতের স্থল সীমান্ত। সব দিকে সমানভাবে খেয়াল রাখা বড়সড় নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ। চোরাচালান এবং অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ভারত সীমান সীমান্ত পাহারা দেয়ার জন্য নিরাপত্তা আরও জোরদার করেছে। চারটি ভাগে ভাগ করে ভারতের সীমান্তের দায়িত্ব দেয়া রয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স, ইন্দো-তিব্বত বর্ডার পুলিশ, আসাম রাইফেলস এবং সশস্ত্র সীমা বল। এর মধ্যে প্রাচীনতম আসাম রাইফেলস। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে আসামের পলল সমভূমিতে চা বাগান এবং ব্রিটিশ স্থাপনা গুলিকে পাহারা দেওয়ার জন্য এটি কাচার লেভি নামে প্রথম তৈরি হয়। ১৯১৭ সালে নাম দেয়া হয় আসাম রাইফেলস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আসাম রাইফেলসের ব্যাটেলিয়ান গুলিকে আসাম পুলিশের অধীনে রাখা হয়েছিল। পরবর্তীকালে সেটি যায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে। ১৯৫৯ সালে যখন চীন তিব্বত আক্রমণ করে তখন যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল আসাম রাইফেলস। ১৯৬২ সালে চিনা আগ্রাসনের পর ইন্দো তিব্বত সীমান্তে গোয়েন্দা এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা পুনর্গঠনের জন্য ১৯৪৯ সালের সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স আইনের অধীনে ইন্দো তিব্বত সীমান্ত পুলিশের চারটি ব্যাটেলিয়ান গঠন করা হয়। সময়ের সাথে সাথে সীমান্ত রক্ষক বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। ১৯৯২ সালে সংসদ ইন্দো তিব্বত বর্ডার পুলিশ ফোর্স আইন প্রণয়ন করে। ২০০৪ সাল থেকে সিকিম এবং অরুণাচল প্রদেশে আসাম রাইফেলসকে সীমান্ত রক্ষার জন্য দায়িত্ব অর্পণ করে ভারত। চীন সীমান্তের পুরো অংশটির দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় আইটিবিপির উপরে। এখানে প্রায় ৬০টি ব্যাটেলিয়ান সহ কর্মীর সংখ্যা রয়েছে ৮৯ হাজারেরও বেশি ।