একমাত্র প্রধানমন্ত্রী যিনি কিনা আমূল বদলে দিয়েছিলেন ভারতের অর্থনীতিকেই , তাঁর যে চারটি বিষয় জানেন না এমনকি অনেকেই
বেস্ট কলকাতা নিউজ : প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিমহা রাওকে ভারতের সর্বোচ্চ অসামরিক পুরস্কার ভারতরত্ন দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী শুক্রবার (৯ ফেব্রুয়ারি) সোশ্যাল মিডিয়া এক্স-এ লিখেছেন, ‘একজন বিশিষ্ট পণ্ডিত এবং রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে, নরসিমহা রাও গারু নানাভাবে ভারতের সেবা করেছেন। তাঁর দূরদর্শী নেতৃত্ব ভারতকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হতে, দেশের সমৃদ্ধি এবং বৃদ্ধির জন্য একটি দৃঢ় ভিত্তি স্থাপনে সহায়ক ছিল।’ কিন্তু, তাঁর এমন অনেক বিষয় আছে, যা অনেকেই জানেন না।
১. নরসিমহা রাও মারা যাওয়ার পরে, সাধারণ কর্মীদের শ্রদ্ধা জানাতে তাঁর দেহ কংগ্রেস সদর দফতরের ভিতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি : রাও মারা যাওয়ার একদিন পর, ২০০৪-এর ২৪ ডিসেম্বর, সকাল ১০টায় একটি ফুলে সজ্জিত সেনার গাড়ি, তাঁর মৃতদেহ নিয়ে দিল্লির মতিলাল নেহরু মার্গে বিমানবন্দরের পথে রওনা দেয়। সেনার গাড়িটি কংগ্রেস দলের সদর দফতর, ২৪ আকবর রোডে থামার কথা ছিল। বিনয় সীতাপতির, ‘Half Lion: How P V Narasimha Rao Transformed India’ অনুসারে সাধারণ কর্মীরা যাতে তাঁদের শ্রদ্ধা জানাতে পারেন, সেজন্য পূর্ববর্তী কংগ্রেস সভাপতিদের মৃতদেহ পার্টির সদর দফতরের ভিতরে নিয়ে যাওয়ার প্রথা ছিল। তবে মিছিলটি সদর দফতরে পৌঁছলেও কংগ্রেস সদর দফতরের গেট খোলা ছিল না। রাও-এর একজন বন্ধু কংগ্রেসের একজন সদস্যকে গেট খোলার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। উত্তরে তাঁকে বলা হয়েছিল, ‘আমরা গেটটি খোলার আশাই করছিলাম। কিন্তু, কোনও আদেশ আসেনি। শুধুমাত্র একজন ব্যক্তি সেই আদেশ দিতে পারেন। তিনি তা দেননি।’ সেনাবাহিনীর গাড়িটি কংগ্রেস সদর দফতরের বাইরে প্রায় আধঘণ্টা অপেক্ষা করে। তারপরে বিমানবন্দরে চলে যায়। রাওয়ের দেহ শেষকৃত্যের জন্য হায়দরাবাদে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এইচডি দেবগৌড়া এবং বিজেপির এলকে আদবানির মতো বিশিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু, তৎকালীন কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীকে সেখানে দেখা যায়নি। সীতাপতি লিখেছেন, ‘সেই রাতে, টেলিভিশন চ্যানেলগুলো (রাও-এর) অর্ধদগ্ধ দেহের ভিজ্যুয়াল দেখায়। মাথার খুলি তখনও দেখা যাচ্ছিল, পড়ে আছে। কিছু কুকুর শেষকৃত্যের চিতা টানাটানি করছিল।’
২. সোনিয়া এবং রাওয়ের মধ্যে তিক্ত সম্পর্কের কারণ : দুই কংগ্রেস নেতার মধ্যে হিমশীতল সম্পর্কের কারণটা ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক এবং সম্ভবত আদর্শগত। একজন কংগ্রেস নেতা, যিনি মনমোহন সিং সরকারের একজন মন্ত্রী ছিলেন, ‘এই সম্পর্কের প্রথম ছেদ ঘটে ১৯৯২ সালে। এস বাঙ্গারপ্পা কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তিনি রাজীব গান্ধীর প্রাইভেট সেক্রেটারি ভিনসেন্ট জর্জকে রাজ্যসভার টিকিট দিতে চেয়েছিলেন। কারণ, জর্জ তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। কিন্তু, রাও সেটা চাননি। তিনি চেয়েছিলেন টিকিট অন্য নেতাকে দেওয়া হোক। রাও বলটা সোনিয়া গান্ধীর কোর্টে পাঠিয়ে দেন। তিনি বলেছিলেন, সোনিয়া গান্ধী যদি বলেন তবে টিকিট জর্জকে দেওয়া হবে। সোনিয়া গান্ধীর মনের অবস্থা সেই সময় বলার মত ছিল না। তাই তিনি হ্যাঁ বলেননি, আবার কখনও না-ও বলেননি। শেষ পর্যন্ত ওই টিকিট সেই ব্যক্তির কাছে গিয়েছিল, যাঁকে রাও চেয়েছিলেন। রাজীব গান্ধীর হত্যা মামলার তদন্ত ধীরে অগ্রগতির জন্যও রাওয়ের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন সোনিয়া। ১৯৯৫ সালে, সোনিয়া গান্ধী প্রকাশ্যে কংগ্রেসের সরকারকে তাঁর স্বামীর হত্যার তদন্তে ধীরগতির দায়ে অভিযুক্ত করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে একজন প্রবীণ নেতা সংবাদপত্রকে বলেন, ‘তিনি (সোনিয়া) অনুভব করেছিলেন যে তিনি (রাও) তদন্তটি এগিয়ে যাক, এমনটা চান না।’ তার ওপর, কংগ্রেস ১৯৯৬ সালের লোকসভা নির্বাচনে পরাজয়ের জন্য রাওকে দায়ী করেছিল। এই ফলাফলের পরে, রাওকে সীতারাম কেশরির পরিবর্তে কংগ্রেস সভাপতি করা হয়েছিল। দুই বছর পর, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনের টিকিট থেকে বঞ্চিত হন।
৩. রাও অযোধ্যাকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে রূপান্তরিত করার এবং এটিকে ভ্যাটিকান-টাইপ মর্যাদা দেওয়ার কথা বিবেচনা করেছিলেন : নীরজা চৌধুরী সম্প্রতি তাঁর সাপ্তাহিক কলামে লিখেছেন যে রাও অযোধ্যাকে একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে রূপান্তরিত করতে এবং এটিকে ভ্যাটিকান-টাইপ মর্যাদা দিতে অধ্যাদেশ আনতে চেয়েছিলেন। তবে সে পরিকল্পনা এগোয়নি। তাঁর বই, ‘হাউ প্রাইম মিনিস্টারস ডিসাইড’,-এ চৌধুরী আরও লিখেছেন যে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের কয়েকদিন পরে, রাওয়ের বন্ধু সাংবাদিক নিখিল চক্রবর্তী তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তিনি রাওকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আমি শুনেছি যে আপনি ৬ ডিসেম্বর রাত ১২টার পরে পূজা করেছিলেন?’ পালটা রাও বলেন, ‘দাদা, আপনি কি মনে করেন যে আমি রাজনীতি জানি না? আমি রাজনীতিতে জন্মেছি। আর, আজ পর্যন্ত শুধু রাজনীতিই করে আসছি। জো হুয়া ওই ঠিক হুয়া। ম্যায় ইস লিয়ে হোনে দিয়া কি, ভারতীয় জনতা পার্টি কি মন্দির কি রাজনীতি হামেশা কে লিয়ে খতম হো যায়ে (আমি এটা হতে দিয়েছিলাম কারণ আমি চেয়েছিলাম বিজেপির মন্দিরের রাজনীতি চিরতরে শেষ হোক)।’ রাও এমনকী একটি মন্দির নির্মাণের কথাও ভেবেছিলেন, যেখানে বাবরি মসজিদ একসময় দাঁড়িয়েছিল এবং এতে প্রতিনিধিত্বকারী প্রধান হিন্দু সম্প্রদায়কে নিয়ে একটি ট্রাস্ট তৈরি করেছিলেন। এমনটাই নিজের কলামে লিখেছেন নিখিল চক্রবর্তী। কিন্তু, পরে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জিতে আসতে পারলে মন্দির নির্মাণ করা হবে। কিন্তু, কংগ্রেস শেষ পর্যন্ত জিততে না-পারায়, রাওয়ের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।
৪. অটলবিহারী বাজপেয়ী রাওকে ভারতের পরমাণু কর্মসূচির ‘সত্যিকারের পিতা’ বলে অভিহিত করেছিলেন : সীতাপতির বই অনুসারে, রাও সক্রিয়ভাবে পরমাণু কর্মসূচিতে জড়িত ছিলেন। ১৯৯১ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সময় তিনি সেই কয়েকজন রাজনীতিবিদদের মধ্যে একজন, যাঁরা এই কর্মসূচির অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতেন। ডিপার্টমেন্ট অফ অ্যাটমিক এনার্জি (ডিএই) এবং ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ডিআরডিও) সেপ্টেম্বর ১৯৯৫ সালের দিকে রাওকে একটি নোট লিখেছিল। সেই নোটে রাওয়ের কাছে ১৯৯৫-এর ডিসেম্বর থেকে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে পোখরানে দুটি বা তিনটি পরমাণু পরীক্ষা চালানোর সুপারিশ করেছিল। ১৯৯৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে গল্পটি প্রকাশিত হয়। আমেরিকান গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞদের সন্দেহ ছিল যে ভারত ১৯৭৪ সালের পর প্রথমবার পরমাণু পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাজস্থান মরুভূমিকে টেস্ট সাইট হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। এমনটাই বলা হয়েছিল ওই রিপোর্টে। পরবর্তীকালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন রাওকে ফোন করেন। ক্লিনটন বলেন, ‘আমরা আপনার বিদেশমন্ত্রীর একটি স্পষ্ট বিবৃতি (প্রণব মুখার্জি, যিনি কর্মসূচিটি সম্পর্কে জানতেন না, এই কর্মসূচি চালাতে অস্বীকার করে প্রকাশ্য একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন) যে ভারত সরকার পরমাণু পরীক্ষা করছে না, তা জেনে আনন্দিত।’ পরিকল্পনা অনুযায়ী রাও উত্তর দেন, ‘আমিও প্রেসের ক্লিপিংস দেখেছি। ওসব মিথ্যা।’ পালটা ক্লিন্টন বলেছিলেন, ‘কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সেটা কী যার ছবি আমাদের ক্যামেরা তুলেছে?’ রাও আবার পরিকল্পনা অনুযায়ী উত্তর দেন, ‘ওটা একটা জায়গার নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ মাত্র।’ রাও তারপর ধীরে ধীরে যোগ করেন, যাতে ক্লিনটন তাঁর ভারতীয় উচ্চারণ বুঝতে পারেন। তিনি বলেন, ‘এটা ঠিক যে এখনই আমাদের বিস্ফোরণের কোনও পরিকল্পনা নেই। তবে হ্যাঁ, আমরা প্রস্তুত। আমাদের সামর্থ্য আছে।’ এমনটাই লিখেছেন সীতাপতি। ক্লিটনের আহ্বান এবং দ্য এনওয়াইটির তথ্য ফাঁস সত্ত্বেও, রাও ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অর্থ মন্ত্রককে, ‘একটি পরমাণু পরীক্ষার অর্থনৈতিক প্রভাব বিশ্লেষণ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।’ বইটিতে এমনটাই জানানো হয়েছে। সেখানে আরও বলা আছে, প্রধানমন্ত্রী পরের মাসে ক্লিনটনের কাছ থেকে আবার একটি ফোন পেয়েছিলেন। যেখানে তাঁকে পরমাণু পরীক্ষায় এগিয়ে না যাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। যদিও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ঠিক কী বলেছিলেন তা জানা যায়নি। তবে, সেই ফোন প্রমাণ করে যে রাও ১৯৯৬ সালের মার্চেই পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষা করার বিষয়টি বিবেচনা করছিলেন। এমনটাই লিখেছেন সীতাপতি। মে মাসে প্রধানমন্ত্রী রাও, যিনি লোকসভা নির্বাচনের জন্য প্রচার চালাচ্ছিলেন, ডিআরডিওর তৎকালীন প্রধান এপিজে আবদুল কালামকে ডেকে বলেছিলেন, পরীক্ষাটি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তাঁর অনুমোদনের জন্য অপেক্ষা করতে। যাইহোক, কয়েকদিন পরে রাও আবার কালামকে পরীক্ষা স্থগিত রাখতে বলার জন্য ডেকেছিলেন। কারণ, ‘নির্বাচনের ফলাফল তাঁর প্রত্যাশার থেকে বেশ ভিন্ন ছিল।’ এমনটাই লিখেছেন সীতাপতি।