বাড়ির পুজো ভবানীপুরে, এখানে দুর্গা ব্রিটিশরূপী অসুরকে দমন করেন ১৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে

বাংলার খবর | বেস্ট কলকাতা নিউজ

বেস্ট কলকাতা নিউজ : পুজোর বাকি হাতে গোনা আর কয়েকটা দিন। বাইরে আকাশের মুখ ভার। নাছোড়বান্দা বৃষ্টি যেন পিছু ছাড়তেই চাইছে না। বাঙালি সারা বছর অপেক্ষায় থাকে পুজোর পাঁচটা দিনের জন্যে। কারণ সুখ, দুঃখ, আনন্দ সবই জড়িয়ে আছে এই উৎসবের সঙ্গে। বৃষ্টির মতিগতি দেখে যা মনে হচ্ছে, তাতে পুজোতে জল ঢালতে পারে। বৃষ্টিতে কাদা মাখামাখি করে থিমের পুজো দেখতে না-পারলে তাই ঢুঁ মারতে পারেন বনেদি বাড়ির পুজোগুলোতে। এই পুজোর সঙ্গে কলকাতা শহরের দীর্ঘ ইতিহাস জড়িয়ে।

শহর কলকাতার অনেক পুজোর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে জমিদার বাড়ির ছোঁয়া। কোনওটার সঙ্গে আবার স্বদেশি আন্দোলনের ইতিহাস। উত্তরে রয়েছে যেমন শোভাবাজার রাজবাড়ি। মধ্য কলকাতার জানবাজারে রানি রাসমণি দেবীর বাড়ির পুজো। দক্ষিণে ঠিক তেমনি ভবানীপুরের দে বাড়ি। এই সব পুজোয় রয়েছে কোনও না কোনও গল্প। যেমন দক্ষিণ কলকাতার দে বাড়ির পুজো। এই পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে স্বদেশি আন্দোলনের চিহ্ন। যা এখনও স্পষ্ট। ভবানীপুরের হরিশ মুখার্জি রোডের দে বাড়ির পুজোতে ব্রিটিশরূপী অসুরকে দমন করেন দুর্গা! পরনে কোট-প্যান্ট। মুখের গড়ন ইংরেজদের মত। অসুরের মাথার চুলও সাহেবদের মতই ধবধবে সাদা।

পড়তে অবাক লাগলেও ভবানীপুরের দে বাড়ির পুজো প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত এই একই নিয়মে হয়ে আসছে। সালটা ১৮৭০। ভবানীপুর দে পরিবারের পুজোর সূচনা করেছিলেন রামলাল দে। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে, গোবরডাঙ্গায়। পরবর্তীকালে ব্যবসায়িক সূত্রে তিনি দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুরে আসেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। পারিবারিক তুলোর ব্যবসার তখন রমরমা অবস্থা। সেই ব্যবসা বংশপরম্পরায় আজও রয়েছে। পরিবারের ষষ্ঠ প্রজন্ম দেবরাজ দে। বাড়ির পুজোর ইতিহাস নিয়ে গল্প করার সময় বলছিলেন, ‘পুজোর শুরু হয়েছিল দেবীর মাতৃরূপী আগমনের মাধ্যমে।

একদিন সন্ধ্যায় এক লালপাড় সাদা শাড়ি পরিহিত মহিলা তাঁর দুই ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে প্রবেশ করেন এই ২৬নং চন্দ্রনাথ স্ট্রিট-এর বাড়িতে। তিনি গৃহকর্তার কাছে কিছু চাল ভিক্ষা চান। গৃহকর্তা যখন ভাঁড়ার ঘর থেকে চাল আনতে যান, তিনি তার সন্তানদের নিয়ে কাউকে কিছু না-বলেই গৃহের দালান থেকে ভিতর মহলে চলে আসেন। বাড়ির এক সদস্যা তৎক্ষণাৎ তাঁর পিছু নেওয়া সত্ত্বেও পরবর্তী মুহূর্তে ওই মহিলা ও তাঁর সন্তানদের বাড়ির কোথাও আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। বেশ কিছু দিন পরে সেই একই বেশে সেই মহিলাকে আবারও দেখা যায় বাড়ির ছাদের কার্নিশে বসে পা দোলাতে। ইতিমধ্যে শ্রী রামলাল দে-ও সেই একই বেশ ধারণকারী মহিলার স্বপ্নাদেশ পান। স্বপ্নে তাঁকে ওই মহিলা বলেন, দেবী দুর্গার পূজা করতে। সেই বছর অর্থাৎ ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকে দেবী দুর্গাকে মাতৃরূপে পুজো শুরু করেছিলেন শ্রী রামলাল দে।

বৃষ্টির জন্যে দে বাড়ির ঠাকুরদালান স্যঁতস্যাঁতে। পুরোনো আলপনার রং উঠে গিয়েছে। মায়ের ঠাকুরদালান সেজে উঠতে এখনও কয়েকদিন বাকি। না সেজেও যেন লালপাড় সাদা শাড়িতে দেবী এখানে অপরূপ সুন্দরী। ঠাকুর দালানে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন ছেলেমেয়েদের নিয়ে। বর্তমানে দেবীর পুজোর আরাধনা করেন রামলাল দে-এর তিন ছেলের মধ্যে দুই ছেলে অতুলকৃষ্ণ দে ও অনুকূলকৃষ্ণ দে-এর বংশধরেরা।

বংশপরম্পরায় প্রতিবছর রথযাত্রার দিন কাঠামো পুজোর মাধ্যমে দেবী দুর্গার আরাধনার সূচনা করা হয় এই বাড়িতে। একচালার সাবেকি প্রতিমা পূজিতা হন একই কাঠামোয়। অর্থাৎ দেবীর বিসর্জনের পর কাঠামো ফিরিয়ে আনা হয়। পরের বছর সেই ১৫০ বছরের পুরোনো কাঠামোতেই দেবী দুর্গাকে প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতিমা তৈরির সব কাজ করা হয় বাড়ির ঠাকুর দালানেই। এই বাড়ির পুজোর আরেকটি বিশেষত্ব হল দেবীর বাহন রূপে থাকা সিংহের গায়ের সাদা রং। দেবী যে ঘরে পূজিতা হন, সেই ঘরে পুরোনো দিনের মাটির মেঝে এখনও অপরিবর্তিত।

এই পুজোর মূল আকর্ষণ ব্রিটিশরূপী অসুরকে দমন করেন দুর্গা। তথাকথিত অসুরের চেহারা বদলে কেন ব্রিটিশরূপে অসুরকে তৈরি করা হয়েছিল? দে পরিবারের সূত্রে জানা গিয়েছে, পুজোটা যখন শুরু হয়েছিল তখন ভারতবর্ষ পরাধীন। ব্রিটিশ সরকারের অত্যাচারে জর্জরিত। দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছিল ইংরেজদের তুমুল অত্যাচার ও অপশাসন। ক্রমশ মাথাচাড়া দিচ্ছিল স্বদেশি আন্দোলন। ব্রিটিশ সরকারের অরাজকতা ও ভারতীয়দের ওপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে অষ্টাদশ শতক থেকে মহিষাসুরকে ব্রিটিশ সাহেবের রূপ দান করা হয়। কালো কোট ও বুট পরা গোরা সাহেব এখানে থাকেন দেবী দুর্গার পায়ের তলায়। দেবী দুর্গা ত্রিশূল দিয়ে সাহেবরূপী অশুভ শক্তিকে বিনাশ করেন। ব্রিটিশ বিরোধী মূর্তির সেই রূপ এই পুজোয় আজও অপরিবর্তিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *